বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বর্ণনা

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্য চরম বিপদের সম্মুখীন হয়। পারস্পরিক সংঘাত ও কঠোর নিয়মের বেড়াজালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর গতি এইসময় স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপরই অবাধ বাণিজ্যর প্রসার ও বিশ্বায়নের লক্ষ্যে পৌছানোর উদ্দেশ্য ভারতসহ সমমনোভাবাপন্ন বেশকিছু দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্য এবং শুল্ক সম্পর্কীয় সমঝোতা চুক্তি নাম একটি সংস্থা গঠন করে।

চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বানিজ্য শুল্ক কমিয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেন বৃদ্দি এবং পারস্পরিক বানিজ্য সংঘাত দূর করা। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি মধ্যে নির্দিষ্ট সময়সীমার ভিতর পর্যায়ক্রমে শুল্ক হ্রাস ও বানিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা নিয়ে প্রবল মতাতন্তর দেখা দেয়। মতানৈক্য না-হওয়ায় অবশেষে তদানিন্তন ডিরেক্টর জেনারেল আর্থার দান্কেল -এর ভার দেওয়া হয় আলোচনার ভিতিতে একটি খসড়া চুক্তির বয়ান প্রনয়ন করার।

দান্কেল প্রণিত প্রস্তাবটি চুক্তির আকারে স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৩ খির্ষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর আর চূড়ান্ত দলিল ১৯৯৪ খ্রিষ্ঠাব্দের ১৫ এপ্রিল মরক্কোয় স্বাক্ষরিত হয়। ভারতসহ এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা বর্তমানে ১৪৮টি। এই চুক্তির ফলশ্রুতি ১৯৯৫ ক্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারী থেকে বিশ্ববানিজ্য সংস্থা (WTO) গঠন হয়। 

বিশ্ববানিজ্য সংস্থার নীতিগুলি

(১) বিশ্বায়নের লক্ষ্য পৌছানোর জন্য সমমনোভাবাপন্ন দেশগুলি মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্য বৃদ্ধি করা। (২) ন্যায্য প্রতিযোগিতাকে উত্সাহ দেওয়া। (৩) মুক্ত বানিজ্য সৃষ্টি করা, বহুমুখী একাধিক বানিজ্য চুক্তির মহ্দ্যমে বাণিজ্যর সপ্রসারণ ঘটানো। (৪) অর্থনৈতিক সংস্কারে উত্সাহ দেওয়া। (৫)বিভিন্ন দেশের মধ্যে চুক্তিমত শুল্ক নেওয়া হচ্ছে কি না তা লক্ষ রাখা। (৬) কেবলমাত্র পণ্য নয়, পরিসেবামূলক বাণিজ্যর প্রসার ঘটানো এই সংস্থার একটি অন্যতম নীতি।

বিশ্বানিজ্য সংস্থার সংথানিক অধিবেশনে ডাকা হয় সদস্য দেশগুলির বানিজ্য মন্ত্রীদের নিয়ে। প্রতি দুবছর অন্তর একবার এই মন্ত্রী পর্যায়ে অধিবেশনে ডাকা হয়। সংস্থার বিভিন্ন কাজ পরিচলনার জন্য একটি সাধারণ সংসদ আছে। সদস্য দেশগুলির প্রতিনিধিরা নিয়ে এই সংসদ গঠিত হয়। সাধারণ সংসদের অধীনে তিনটি পৃথক সংসদ আছে(১)পণ্যসামগ্রী বাণিজ্যর সংসদ (২)পরিসেবা বাণিজ্যর সংসদ এবং (৩) মেধাস্বত্ত্ব সংক্রান্ত সংসদ।

বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাজ – বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা প্রধানত বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়মনীতির সমন্বয়সাধন, সেগুলির সার্থক রূপায়ণ এবং বহুমুখী বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সংস্থার সদস্য দেশগুলির মধ্যে আলাপ আলোচনা মঞ্চ হিসাবে কাজ করে। এ ছাড়াও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাজগুলি বিভিন্ন ধরনের। যেমন –

বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাজ

(১) বহুজাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা: একসময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেবলমাত্র দ্বিজাতিক স্তরে কেন্দ্রীভূত ছিল। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অন্যতম কাজ হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে দ্বিজাতিক স্তর থেকে নিয়ন্ত্রনহীন বহুজাতিক বাণিজ্যর স্তরে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(২) বাজারে অবাধ প্রবেশাধিকার: বাজারে অবাধ প্রবেশাধিকার ছাড়া নিয়ন্ত্রণবিহীন বহুজাতিক সম্ভব নয়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অধীনস্থ স্বাক্ষরকারী দেশগুলির মধ্যে বানিজ্যিক শুল্ক এবং আনুষঙ্গিক বিধিনিষেধ হ্রাস বা প্রত্যাহিত করে এই সংস্থা অবাধ বাণিজ্যর সুযোগ করে দেয়।

(৩) প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে মেধাগত সর্বস্বত্ব সংরক্ষণের ব্যবস্থা: ডাক্কেল আইনে কোনো দ্রব্য ও প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া যা শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তার মেধাগত অধিকারস্বত্ব উদ্ভাবিত দেশটিকে আবেদনের সময় থেকে আগামী ২০ বছর ধরে সংরক্ষণের অধিকার দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ওই নতুন দ্রব্যটি বা প্রযুক্তিগত প্রক্তিয়াটি সদস্য দেশগুলিতে বৈষম্যহীনভাবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। তবে মেধাগত স্বত্বধিকারীই কেবলমাত্র ওই দেশের দ্রব্য অথবা প্রক্রিয়াটি বিক্রয় করার একমাত্র অধিকারী।

(৪) পরিসেবামূলক বাণিজ্যর প্রসার: ডানকেল আইন বলে পরিসেবামূলক বাণিজ্যর ক্ষেত্রে সব দেশেই সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি। এর ফলে বিশ্ববানিজ্য সংস্থার অধীনস্থ দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৈষম্য দূর হয় এবং ব্যাঙ্ক, বিমা, পরিবহন, কম্পিউটার সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়ন, সড়ক, সেতু নির্মান, হোটেল, চলচিত্র প্রভৃতি পরিসেবামূলক বাণিজ্যর আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক প্রসার ঘটে।

সুতরাং, বিশবাণিজ্যর সংস্থার কাজ হল তার অধীনস্থ চুক্তিবদ্ধ দেশগুলির মধ্যে পরিসেবামূলক বাণিজ্যর প্রসার ঘটানো।

(৫) বিভিন্ন প্রকার চুক্তির সার্থক রুপায়ন: ‘গ্যাট’ -এর উরুগুয়ে রাউন্ডের বৈঠক শেষে যেসব চুক্তি চূড়ান্ত হয়, সেগুলি বিভিন্ন সংসদ কমিটির মাদ্দ্যমে রূপায়নের ব্যবস্থা করা।

(৬) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সম্প্রসারণ: বিশ্বজুড়ে যেসব বানিজ্যিক বাধা আছে, সেগুলিকে যতটা সম্ভব কমিয়ে এই সংস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সম্প্রসারণ ঘটানোর চেষ্টা করবে।

(৭) কৃষিজাত পণ্যর আমদানি ও রপ্তানির প্রসার ঘটায়: ডাক্কেল আইনের অন্যতম শর্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কৃষিজাত পণ্যর বাণিজ্যর শিবৃদ্ধি ও প্রসারের জন্য প্রত্যেকটি দেশকে একটি নূনতম পরিমান আমদানি করতেই হবে।

যেক্ষেত্রে পরিমান অতি সামান্য, সেক্ষেত্রে পন্যটি অভ্যন্তরীণ মোট ভোগের অন্ততপক্কে তিন শতাংশ আমদানি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্যদিকে যে দেশগুলি বর্তমানে পন্যটি ন্যুনতম ৩ শতাংশের বেশি আমদানি করছে তাকে ক্রমশ বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(৮) মেধাস্বত্ব অধিকার: মেধাস্বত্ব অধিকার সঠিকভাবে রক্ষিত হচ্ছে কি না এবং সদস্য দেশগুলি সেই নীতি মেনে চলছে কি না সে বিষয়ে লক্ষ রাখা।

(৯) সুযোগসুবিধা ভোগ: প্রতিটি সদস্য দেশ যাতে বানিজ্য সংক্রান্ত সমান সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করা।

(১০) আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে সহযোগিতা: অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ও তার সহযোগী সংস্থাগুলি সঙ্গে সম্পুর্ন সহযোগিতা করা বিশ্ববানিজ্য সংস্থার অন্যতম কাজ।

আরও পড়ুন,

সরকারি ক্ষেত্র কি তার বৈশিষ্ট্য এবং তার প্রয়োজনীয়তা

বেসরকারী ক্ষেত্র কি তার বৈশিষ্ট্য

বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং কি এবং তার সুবিধা অসুবিধা

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাকে বলে এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য

Leave a comment