আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাকে বলে এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধা

পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের চাহিদা। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদাপূরণের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন দ্রব্যর উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সুযোগসুবিধা সকল দেশে সমানভাবে পাওয়া যায় না। ফলে কোনো দেশই সকল প্রকার দ্রব্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী নয়। তাই প্রত্যেক দেশই তার উদবৃত্ত পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করে এবং তার বিনিময়ে নিজ দেশের প্রয়োজনীয় দ্রব্যদী অন্য দেশ থেকে আমদানি করে।

যখন কোনো দেশের রাজনৈতিক সীমা অতিক্রম করে ওপর কোনো দেশের সঙ্গে পণ্যদ্রব্যর বা সেবাকর্মের ক্রয়বিক্রয় বা আদানপ্রদান সংঘটিত হয় তখন তাকে আন্তর্জাতিক বানিজ্য বলে। যেমন- ভারতের সঙ্গে ইংল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া আদানপ্রদান।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর শ্রেণীবিভাগ

আন্তর্জাতিক বানিজ্যকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় যেমন –

(১) আমদানি বানিজ্য – যখন কোনো দেশ নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্য দেশ থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয় করে, তখন তাকে আমদানি বানিজ্য বলে। যেমন – ভারত বিদেশ থেকে বিভিন্ন শিল্পজাত দ্রব্য ও কারিগরী পরামর্শ আমদানি করে।

(২) রপ্তানি বানিজ্য – যখন কোনো দেশ নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকার্য অন্য দেশের কাছে বিক্রয় করে তখন তাকে রপ্তানি বানিজ্য বলে। যেমন- ভারত বিদেশে চা ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে।

(৩) পুনঃরপ্তানি বানিজ্য – যখন কোনো দেশ অন্য দেশ থেকে পণ্য ক্রয় করে সেই পন্যটি আবার ওপর কোনো দেশে বিক্রয় করে তখন তাকে পুনঃরপ্তানি বানিজ্য বলে। যেমন – শ্রীলঙ্কা ভারত থেকে কয়লা ক্রয় করে যদি পাকিস্তানের কাছে বিক্রয় করে তবে তা হবে শ্রীলংকার পুনঃরপ্তানি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর বৈশিষ্ট্য

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর নিজস্ব কতকগুলি বৈশিষ্ট্য থাকার ফলে আন্তর্জাতিক বানিজ্যকে অভ্যন্তরীণ বানিজ্য থেকে পৃথকীকরণ করা সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর বৈশিষ্ট্যগুলি হল

(১) আমদানি ও রপ্তানি – আন্তর্জাতিক বানিজ্য এক দেশ যখন অন্য দেশ থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয় করে তখন তাকে আমদানি বানিজ্য বলে। আবার নিজের দেশের উপাদিত পণ্য বা সেবা অন্য দেশে বিক্রয় করলে তাকে রপ্তানি বানিজ্য বলে। এইভাবে একাধিক দেশের মধ্যে পণ্যর বা সেবার আদানপ্রদান করাই হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর মূল বৈশিষ্ট্য।

(২) বৈদেশিক মুদ্রা: আন্তর্জাতিক বানিজ্য যে দেশগুলির মধ্যে সংঘটিত হয় সেই দেশের মুদ্রায় বিনিময় হয়। যেমন – ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বৈদেশিক বানিজ্য সংঘটিত হয় টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময়ে।

(৩) আদানপ্রদানের মাধ্যম: আন্তর্জাতিক বানিজ্য সাধারণত সমুদ্রপথ বা আকাশপথের মাধ্যমে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্থলপথে হয়ে থাকে।

(৪) প্রকারভেদ: আন্ত্রজাতিক বানিজ্য তিন প্রকারের হতে পারে: (i) আমদানি বানিজ্য (ii) রপ্তানি বানিজ্য এবং (iii) পুনঃরপ্তানি বানিজ্য

(৫) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ: পৃথিবীর সমস্ত দেশেই আন্তর্জাতিক বানিজ্য রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর গতিপ্রকৃতি, পণ্যদ্রব্য আমদানি বা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বা নির্ধারণ সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ সহ নানা নিয়মনীতি পরিচালনা করে রাষ্ট্র।

(৬) আন্তর্জাতিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা: দেশের অভ্যন্তরে পণ্যর ঘাটতির জন্য কোনো একটি দেশকে অন্য একটি দেশের উপর নানাভাবে নির্ভর করতে হয়। পণ্যর আদানপ্রদানের ফলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর মূল ভিত্তি হল আন্তর্জাতিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা।

(৭) উত্পাদক ও ভোগকারীর ভিন্ন দেশে অবস্থান: আন্তর্জাতিক বানিজ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা অবস্থান পৃথক পৃথক দেশে হওয়ায় ফলে এক দেশের উত্পন্ন পণ্যসামগ্রী অন্য দেশের লোকেরা ভোগ করে।

(৮) আইন অনুযায়ী দলিল প্রনয়ন: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ক্ষেত্রে একাধিক রাষ্ট্রের আইন মেনে চলতে হয় এবং একাধিক অনুযায়ী দলিলপত্রগুলি সম্পাদন করতে হয়।

(৯) যোগাযোগ ব্যবস্থা: আন্তর্জাতিক বানিজ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব নয়।

(১০) ব্যাঙ্ক ও বিমার প্রয়োজনীয়তা: ব্যান্ক ও বিমার সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। কারণ আন্তর্জাতিক বানিজ্য মুদ্রার বিনিময় হার সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাহায্য ও অনুমোদন প্রয়োজন।

(১১) ঝুঁকি: আন্তর্জাতিক বানিজ্য মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি খুব বেশি। তা ছাড়া প্রচুর মূলধন বিনিয়োগের ঝুঁকিও আছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সুবিধা

(১) আন্তর্জাতিক বিশেষিকরণ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ফলে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যর উত্পাদনে বিশেষায়ন লাভ করে। শ্রমবিভাগ ও বিশেষায়ন দরুন আন্তর্জাতিক ব্যবসায় অংশগ্রহণকরি দেশগুলি কম মূল্য দ্রব্য উত্পাদন করতে পারে।

(২) ক্রয়বিক্রয়ের সুবিধা: প্রত্যেক দেশ আপেক্ষিক সুবিধা অনুযায়ী পণ্য উত্পাদন করে। যে দেশে যে পণ্য উত্পোদন আপেক্ষিক সুবিধা কম, সেই দেশগুলি সেই পণ্য উত্পাদন না করে অন্য দেশ থেকে সেই পণ্য ক্রয় করে তাদের প্রয়োজন মেটায় এর ফলে উভয় দেশই ক্রয়বিক্রয়ের সুবিধা ভোগ করে।

(৩) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ফলে বিশ্বের একাধিক দেশ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রেশারেশি দুরুভূত হয়ে সহযোগিতায় পথ প্রশস্থ হয়ে উঠেছে। যেমন- বর্তমানের গ্যাট চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী শতাধিক দেশ পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া মাধ্যমে কারবার পরিচলনা করছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর অসুবিধা

(১) সংঘর্ষ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করার জন্য অধিকাংশ দেশই চেষ্টা চালায়। ফলে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

(২) রাজনৈতিক অবন অর্থনৈতিক প্রভাব: অসম প্রতিযোগিতার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রগুলির উপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাববিস্তার করে। ফলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় বঞ্চিত হয়।

(৩) পরনির্ভরশীল: এই ধরনের বানিজ্য ফলে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন,

বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাজ

সরকারি ক্ষেত্র কি তার বৈশিষ্ট্য এবং তার প্রয়োজনীয়তা

একমালিকি কারবারের বর্ণনা

Leave a comment