একটি কলমের আত্মকথা

আমাকে দেখে কিন্তু তোমরা ভুল করো না। আমি কিন্তু এই কলকাতারই লোক। আমাকে শ্রীরামপুরের একটি ছোট কারখানায় তৈরী করা হয়েছে। তারপর আমার গায়ে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘মেড ইন চায়না’ কেন, কে জানে। কয়েকদিন পরে দোল বেঁধে আমরা কলকাতায় তৈরী মেড ইন চায়নার দোল বিক্রি হবার জন্য বের হলাম।

বিক্রয়ের ঘটনা

আমি গিয়ে হাজির হলাম এক খুব ঝলমলে এল সাজানো দোকানয়ালা একটি বর রাস্তায়। কলকাতার সবচেয়ে কুলীন রাস্তা এই চৌরঙ্গী। এখানে বিরাট সব দোকান। ঝকঝকে সব মোটর গাড়ি। নতুন জিনিসপত্র এত আর কোথাও নেই। আবার যত চোর জোচ্চোর পকেটমার ভিড় এই পাড়ায়। সেখানে কয়েকটি ছেলে চীনা কলম বিক্রি করছিল। আমি সেই ছেলেগুলোর মধ্যে একটার হাতে পরলাম। ও বাসের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

জায়গাটা একটু আলো-আঁধারী। ছেলেটির নাম কবির। এমন ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে ছিল যাতে মনে হয় এর মধ্যে খুব গোপন একটা ব্যাপার আছে। বিদেশী জিনিস অর্থাৎ বিদেশ থেকে চোরাই চালানোর জিনিস যেন খুব সস্তা করে দিচ্ছে। মাত্র পাঁচ-ছয় টাকার যেন তিরিশ-পয়তিরিশ টাকা দামের বিদেশী কলম পাওয়া যাচ্ছে। একটু ভালো জামা-কাপড় পরা লোক দেখলেই কবির এগিয়ে যায়।

কিন্তু গলায় ফিস ফিস করে বলে বাইরের জিনিস, জলের দামে পাচ্ছেন মহাশয়। কেউ কেউ না নিয়েই চলে যায়। কেউ সামান্য কৌতুহল দেখায়। কেউ আবার শেষ পর্যন্ত কলম একটা-আধটা কিনেও ফেলে। শেষে একদিন এক ভদ্রলোক একটুখানি দর কষাকষি করে আমাকে কিনে নিলেন। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখে দেখলেন পছন্দ হল তাঁর। আমাকে দিয়ে ভালো করে লেখা যায় কিনা সে কথাও আমি জানি না।

আমার শহরের অভিজ্ঞতা

ভদ্রলোক আমাকে বুক পকেটে রেখেদিলেন। তারপর উঠলেন ট্রামে। ট্রামে খুব ভিড় ছিল। চাপাচাপি ঠেলাঠেলির মধ্যে হটাত একটা চালক মত লোক আমাকে তুলে নিয়ে গেল। এই ট্রামের মধ্যে একের পর এক হাত হতে হতে আমি এক অন্য প্রান্তে পৌছে গেলাম। আমাকে যিনি কিনেছিলান তিনি বুঝতে পেরেছিলেন – তাই তিনি পকেটমার বলে চিত্কার করতে আরম্ভ করেছিলেন।

চারদিকে একটা হৈচৈ ধাক্কাধাক্কি মধ্যে আমি যার কাছে ছিলাম সেই লোকটা ট্রাম থেকে নেমে পড়েন। ট্রাম থেকে নামতেই সাদা পোশাক পরা একটা লম্বা জোয়ানলোক তাকে চট করে ধরে ফেলল -এইবার তোমাকে ধরেছি। তোমার পকেট মেরে বেড়ানো এখানেই ইতি। চল থানায় বুঝলাম লোকটা পুলিশ। পকেটমার আমাকে ফেলে দিল পথের ,মধ্যে। পুলিশটি কিন্তু টের পেল না।

শহরের কষ্ট ভরা জীবন

রাস্তার কাদার মধ্যে সে রাতটা আমি কাটালাম। তবে আমি নাকি নির্জীব পদার্থ। তাই আমার সুখদুখ কোনো অনুভূতি নেই। আমার কোনো কষ্টই হল না। রাত শেষ হতে না হতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সারাদিন সেই বৃষ্টিতে ভিজলাম। ঝড়ের ঝাপটা খেলাম। রাস্তায় লোকজন নেই, গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ। চারিদিকে জল জমে গিয়েছে। পরের দিন সকালে আবার ঝলমলে রোদ উঠেছে আকাশে।

সকালবেলায় একটা ছেড়া জামা পরা ভিখারী ছেলের নজরে পরে গেলাম। আমার চকচকে শরীরটি দেখে তার চোখটা চিকচিক করে উঠল। একজন লোক যাচ্ছিল পথ দিয়ে। ছেলেটি তাকে এগিয়ে বলল – বাবু একটা কলম নেবেন। একদম নতুন কলম দুটো টাকায় পাবেন। লোকটা কিছু না বলে চলে গেল।

হটাত পিছন থেকে এক আধবুড়ো লোক এসে একটানে আমাকে কেড়ে নিল ভিখারী ছেলেটার হাত থেকে। বুড়োটা ছেলেটাকে ধমকে বলল বেটা চোর আমার পকেট থেকে তুলে নিয়ে বিক্রি করছিস। মেরে হাড় ভেঙ্গে দেব। লোকটা আমাকে পকেটে ফেলে হন হন করে লম্বা পা ফেলে চলে গেল।

উপসংহার

প্রথমে সে ঢুকল একটা পোস্ট অফিসে। একটা পোস্টকার্ড কিনল। খসখস করে আমাকে দিয়ে লিখল – স্নেহের খোকা, তোমার জন্য একটা সুন্দর কলম কিনেছি। হটাত হাত পিছলে আমি পরে গেলাম। আমার নিবটি উল্টে গেল। আমাকে তুলে বুড়োটি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

আমাকে ওই অবস্থাতে ফেল দিল রাস্তায়। তার পাশে এসে উড়ে পড়ল একটা ছেঁড়া পোস্টকার্ড। আমি বুঝতে পারলাম যে আমি আর কোনো কাজের নই।

আরো পড়ুন,

খনিজ তেলের রচনা

আমার শখ রচনা

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ রচনা

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ রচনা

Leave a comment